২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। সেদিন বিকেলে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা ছাত্রনেতা আবু সাঈদ।
কিন্তু ঢাকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র দেখা যায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে তখন আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রী আবদুর রহমান তার অফিসে অনায়াসে বসে স্থানীয় এক কবির কবিতা পাঠ উপভোগ করছিলেন। সে দিনের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আবদুর রহমান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, তার ডান গালের ওপর মুষ্টি রেখে নীরবে শুনছেন। পাঠ শেষে তিনি হালকা হাসি দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘দারুণ’। কিছুক্ষণ পর, একজন সহকারী যখন তাকে সাঈদের হত্যার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার খবর জানায়, তিনি বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ও কিছু হবে না। নেত্রী সামলে নেবেন।’
বাংলাদেশজুড়ে যখন সহিংস পরিস্থিতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন একজন মন্ত্রীর এমন স্বাভাবিক আচরণ অনেকের কাছে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যেই শেখ হাসিনার সরকার, যাকে কর্তৃত্ববাদী ও নৃশংস বলে অভিযুক্ত করা হয়, ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়। এ বিদ্রোহ ১ জুলাই শুরু হয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে শেষ হয়। তাতে অন্তত ৮৩৪ জন নিহত হয় বলে সরকারি হিসাবে বলা হয়। আরও ২০ হাজার জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে।
এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের পর্দা নামে। পাঁচ মাস পরও আওয়ামী লীগ নিজেদের পুনর্গঠন করতে লড়াই করছে। দলের অভ্যন্তরে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে– একদিকে ক্ষমাশীল না হওয়া প্রবীণ নেতারা, আর অন্যদিকে মধ্যম স্তরের নেতাকর্মীরা যারা মনে করেন দলকে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এই বিভাজন কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা-ই দলটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
তৃণমূল বনাম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব : বিভক্ত দল
অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এখনো দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাসিম ১৬ জানুয়ারি একটি অজানা স্থান থেকে আল জাজিরাকে ফোনে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। এটা শিগগিরই প্রমাণিত হবে।’ তবে তিনি স্পষ্ট করেননি, তিনি কাকে অভিযুক্ত করছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন দাবি দলটির ব্যর্থতা স্বীকার করতে না পারা এবং জনগণের অসন্তোষ মোকাবিলায় অক্ষমতার পরিচায়ক।
এর ফলে দলটির তৃণমূল কর্মীরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তাদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে আছেন বা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আইনি প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভীত। তারা আক্ষেপ করেন, দলটি জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত একটি সংগঠন থেকে একতরফাভাবে শীর্ষ নেতৃত্বাধীন কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। জনতার ঢল হাসিনার সরকারি বাসভবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে গণভবন থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে পালিয়ে যান। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) একজন সিনিয়র স্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আল জাজিরাকে বলেন, ‘যখন এই নাটকীয় পালানোর দৃশ্য টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল, তখন আমি এখনো খুলনার রাস্তায় কিছু কর্মীর সঙ্গে ছিলাম। আমি স্থানীয় সাংসদের কাছে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তার ফোন বন্ধ ছিল। তখনই আমি নিজেকে প্রতারিত মনে করেছি।’
একই বছরের ২৩ অক্টোবর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিসিএলকে নিষিদ্ধ করে। খুলনার ওই প্রভাবশালী বিসিএল নেতা নিজের নিরাপত্তার জন্য পাশের জেলা গোপালগঞ্জে পালিয়ে যান। পরে ঢাকায় মিথ্যা পরিচয়ে অবস্থান নেন। সেই ছাত্রনেতা বলেন, ‘আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, ফোন নম্বর- সবকিছু পরিবর্তন করেছি। বেঁচে থাকার জন্য আমি একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছি। দল আমাদের ছেড়ে দিয়েছে। আমি আর কখনো রাজনীতিতে ফিরে যাব না।’